বিষয়ঃ- আজ আমরা পানের রোগ ও পান বরজের যত্ন নিয়ে আলোচনা করব।
ভূমিকা – পান একটি অর্থকারী ফসল। আমাদের দেশে পান ও পানের বরজ এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দেশে বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। এতে অনেক ঔষধি গুণ বিদ্যমান। কিন্তু রোগবালাই পান উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। পানে গোড়া পচা, ঢলে পড়া, পাতা পচা, অ্যানথ্রাকনোজ, সাদা গুঁড়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
প্রশ্ন – ০১/ পানের কি কি জাত আছে ?
উত্তর – পানের কয়েকটি উন্নত জাত : বাংলা (কালীঢল, বেনারসী, ভবানী, আইমাল, কোরে বাঙাল বা গেঁঠে বাঙাল ), সাঁচী (বনলতা, সোনালি) এবং মিঠাপাতা (থাকপালা, গাঁটপালা ও পালামুক্ত হাইব্রিড)। বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক এই নাম হয়ে থাকে।
প্রশ্ন – ০২/ পানের কি কি রোগ হয় ও এর প্রতিকার কিভাবে করতে হবে ?
উত্তর – পানের কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
কাণ্ড পচা/গোড়া পচা , শিকড় পচা , গোড়া-লতা ও পাতা পচা , ক্ষত বা পাতার দাগ , সাদা গুড়া ।
ক. রোগের নাম : কাণ্ড পচা/গোড়া পচা (Stem rot/Collar rot/Foot rot)
রোগের লক্ষণ : – গাছের যে কোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে। এ রোগ গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গোড়ায় লক্ষ করলে দেখা যাবে মাটির কাছের একটি বা দুটি পর্ব মধ্য কালো বর্ণ ধারণ করেছে। মাটি সংলগ্ন ডাঁটা পচে যায় এবং গাছ ঢলে পড়ে মরে যায়।
রোগের প্রতিকার :রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। গভীর ভাবে জমি চাষ দিয়ে রোদ্রে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে।
পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
খ. রোগের নাম : শিকড় পচা (Root rot)
রোগের লক্ষণ :– গাছের শিকড়সহ মাটির নিচের সব অংশই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় পাতা মলিন হয়ে ঢলে পড়ে। পরে লতা ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে মরে যায়। এ অবস্থায় শিকড় লাল বর্ণ দেখায় এবং ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার : রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
গ.রোগের নাম : ঢলে পড়া (Wilt)
রোগের লক্ষণ :গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গাছের উপরের পাতা হলুদ হয়ে যায়।
কাণ্ডের ভাস্কুলার টিস্যু আক্রমণ করে। গোড়ার দিকে কাণ্ড লম্বালম্বিভাবে ফাটালে ভেতরে দাগ দেখা যায়। পরে গাছ ঢলে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মরে যায়।
রোগের প্রতিকার :রোগাক্রান্ত গাছ তুলে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
গাছের গোড়ার চতুর্দিকের পৃষ্ঠের মাটি নেড়ে শুষ্ক করে দিলে এ রোগ অনেকাংশে দমন হয়।
বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
প্রশ্ন – ০৩/ পান ও পান বরজের কি কি যত্ন করতে হবে ?
উত্তর – একটি আদর্শ পান বরজ তৈরী করার জন্য করণীয় বিষয়গুলো হল :
ক) সঠিক জমি নির্বাচন : উঁচু, উর্বর, জল নিকাশীযুক্ত দোঁয়াশ, এঁটেল দোঁয়াশ মাটিই এই চাষের জন্য উপযুক্ত। মাটির পি. এইচ. (অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব) এর মান ‘৭’ এর কাছাকাছি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বরজের জমির তল বা প্লেট চারপাশের জমির তল থেকে কমপক্ষে ১০-১৫ সেমি উঁচু হতে হবে।
খ) জমি তৈরী বা প্লেট তৈরী এবং মাটি শোধন :
প্রচুর পমিাণে জৈব সার (কম্পোস্ট, খইল) জমিতে দিয়ে তিন চারবার চাষ দিয়ে ভালভাবে মাটির সাথে মেশাতে হবে।
এর পরে বরজের জমির তল বা প্লেট পিটিয়ে শক্ত করতে হবে। একটি সাদা স্বচ্ছ পলিথিন চাদর দিয়ে কমপক্ষে একমাস প্লেট ঢেকে রাখতে হবে।
পনেরো দিন পর পলিথিন তুলে ৪০ শতাংশ ফরমালিনের দ্রবণ (মাত্রা ৬ মিলি প্রতি লিটার জলের সাথে মিশিয়ে) দিয়ে ভাল করে ভিজিয়ে দিয়ে পুনরায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
১০ দিন পর একই ভাবে পলিথিন তুলে ফরমালিন জল দিয়ে প্লেট ভিজিয়ে দিতে হবে এবং ঢেকে দিতে হবে।
এর ৫-১০ দিন পর ঐ জমিতে ভাটি/মাদা/পিলি তৈরী করে চারা লাগানো যাবে। বরজে যে মাটি দেওয়া হবে, সেই মাটি তুলে এক জায়গায় জমা করে রাখতে হবে এবং একইভাবে ফরমালিন ও পলিথিন দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বদাই স্বচ্ছ সাদা পলিথিন দিয়ে মাটি ঢেকে রাখতে হবে।
গ) “মা” গাছ নির্বাচন : – পছন্দ মত জাত নির্বাচন করে স্থানীয় কোন বরজ থেকেই চারা সংগ্রহ করা ভাল।রোগমুক্ত (বিশেষ করে আঙ্গারী) সুস্থ, সবল, সতেজ, ৪-৫ বৎসরের পুরানো পান গাছ থেকেই চারা বা লতা সংগ্ৰহ করতে হবে।
ঘ) চারা/লতা/বীচন শোধন এবার ছায়াতে শুকিয়ে চারাগুলিকে শিকড় বৃদ্ধিকারক হরমোন যথা রুটেক্স, রুটগ্রড, কাটিংএড, অক্সিরুট প্রভৃতি যে কোন একটি ২-৩ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে ৪-৫ মিনিট চুবিয়ে ছায়াতে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর উক্ত চারাগুলিকে ভাটিতে বা পিলিতে লাগাতে হবে।
ঙ) লতা/চারা লাগানোর দূরত্ব :দুটি ভাটি বা পিলির মধ্যে দূরত্ব থাকা উচিত ৫০-৫৫ সেমি এবং দুটি চারার মধ্যে দূরত্ব থাকা উচিত ১০-১৫ সেমি।
চ) বরজের গঠন 🙁 উচ্চতা : বরজের উচ্চতা ২ মিটার অর্থাৎ ৬ ফুট এর কাছাকাছি হতে হবে।
ছাউনি : প্রখর রোদ যাতে না লাগে তার জন্য প্রয়োজনীয় ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় পাতা ফ্যাকাসে, সাদাটে হয়ে যাবে।বর্ষাকাল ও শীতকালে ছাউনি কমাতে হবে যাতে হাল্কা রোদ লাগে। কিন্তু ঠাণ্ডা বাতাস, কুয়াশা, ঝোড়ো হাওয়া যাতে গাছে না লাগে এবং এতে যাতে গাছ নষ্ট না হয় তার জন্য চারপাশের বেড়া ভাল করে দিতে হয়।