পেঁয়াজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল । পেঁয়াজ মসলা ও সবজি হিসাবে ব্যবহার হয়।বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের খাবারের অত্যাবশ্যকীয় অংশ পিঁয়াজ। ফলে চাহিদার ভিত্তিতে (জনপ্রতি দৈনিক ৩৫ গ্রাম) মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। উৎপাদনের বিবেচনায়ও এ মসলা ফসলটি প্রথম স্থানে আছে। কিন্তু পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য।সংগ্রহ মৌসুমে পেঁয়াজ এর ব্যাপক সরবরাহ থাকার কারণে কৃষক খুবই কম মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করে থাকে। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় চাষ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে কৃষক ব্যাপক ভাবে লাভবান হতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে ২৮৫.৬৬ হাজার একর জমিতে প্রতি বছর প্রায় ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বছরে পেঁয়াজ অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৫-৬ লক্ষ মেট্রিক টন। সরকার দেশের পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে প্রায় ১০ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। তাই পেঁয়াজ উৎপাদন বৃব্ধি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
প্রশ্ন ১ :- পিঁয়াজের চাষ কখন, কিভাবে করা যায় ?
উত্তর ঃ- রবি এবং খরিপ দুই মৌসুমেই পিঁয়াজ চাষ করা যায়। রবি পেঁয়াজের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় কার্তিক মাসের ১৫-৩০ (নভেম্বর ১-১৫) তারিখ। পেঁয়াজের রোপণ দূরত্ব বেশি হলে গলা মোটা হয়ে যায় এবং পেঁয়াজ ফেটে যায়। সরাসরি বীজ বপনকৃত পেঁয়াজের তুলনায় চারা রোপণ পদ্ধতিতে উৎপাদিত পেঁয়াজে তুলনামূলক ভাবে বোল্টার (ফুল উৎপাদনকারী কন্দ) ও বহুকোষী পেঁয়াজের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে।
প্রশ্ন ২ :- পিঁয়াজ চাষ কি ধরনের মাটিতে করা যায় ?
উত্তর ঃ- উর্বর বেলে-দো-আঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য অতি উত্তম। বর্ষায় পেঁয়াজ চাষের জন্য উঁচু জমি দরকার যেখানে বৃষ্টির পানি জমে না। জমিতে সেচ ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রশ্ন ৩ :- পিঁয়াজের কিকি জাত চাষ করা যায় ?
উত্তর ঃ- উচ্চ ফলনশীল শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন স্বল্প সময়ের ফসল হচ্ছে পিঁয়াজ।
স্থানীয় জাতঃ- স্থানীয় জাতের মধ্যে তাহেরপুরী, ফরিদপুরের ভাতি, ঝিটকা, কৈলাসনগর উল্লেখযোগ্য। আগাম রবি মৌসুমে তাহেরপুরি ,ফরিদপুরের ভাতি এ জাত দুটির ফলন দ্বিগুন হয় এবং কন্দের মানও উন্নত হয়।
উচ্চ ফলনশীল জাত ঃ- উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যে বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩ এবং বারী পিঁয়াজ-৪। দৃঢ় ও আঁটসাঁটে, ঝাঁঝ বেশি, পানি কম, আকারে মধ্যম, গলা চিকন, উচ্চ শুষ্ক পদার্থ সম্বলিত বৈশিষ্ট্যের জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেশি। বারি পেঁয়াজ-৪ জাতের পেঁয়াজে এন্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে।
প্রশ্ন ৪ :- পিয়াঁজের চারা রোপন কিভাবে করতে হয় একটু বলেন ?
উত্তর ঃ- ৫ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। ৪০-৪৫ দিন বয়সের চারা লাগানোর উপযোগী হয়। ১৫x১০ সে.মি. দূরত্বে চারা রোপন করা হয়। বর্ষার সময় ১ মিটার চওড়া ও ১৫ সে.মি. উঁচু বেড তৈরি করে চারা রোপণ করা হয়। দুই বেডের মাঝে ৩০ সে.মি. চওড়া পানি নিকাশের নালা রাখা হয়। সরাসরি বীজ বপনকৃত পেঁয়াজের তুলনায় চারা রোপণ পদ্ধতিতে উৎপাদিত পেঁয়াজে তুলনামূলক ভাবে বোল্টার (ফুল উৎপাদনকারী কন্দ) ও বহুকোষী পেঁয়াজের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে।
প্রশ্ন ৫ :- পিয়াজ চাষে কিকি সার দিতে হয় একটু বলেন ?
উত্তর ঃ- পেঁয়াজের জমিতে প্রতি হেক্টরে গোবর ৮-১০ টন, ইউরিয়া ২৫০-২৭০ কেজি, টিএসপি ১৯০-২০০কেজি এবংএমওপি সার ১৫০-১৭০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময় দুই-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও বাকী সমুদয় রাসায়নিক সার মাটিতে মেশাতে হবে।চারা রোপনের ২০ দিন পর বাকী ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।পেঁয়াজ সংগ্রহের ২৫-৩০ দিন আগেই নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা বন্ধ করতে হবে।এই সময়ের ভিতর নাইট্রোজেন সার উপরি প্রয়োগ করলে ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে সংরক্ষণাগারে বাল্ব পচে যায়। পেঁয়াজ চাষে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন প্রয়োগ করলে স্টোরে পেঁয়াজের আগাম অংকুরোদগম হয়ে যায়। কোন কারণে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করে থাকলে পরবর্তীতে পটাশ সার (এমওপি) প্রয়োগ করলে পচনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া পটাশ সার প্রয়োগে কার্বহাইড্রেট ভাঙনকারী এনজাইমের কার্যকারিতা কমিয়ে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়।প্রয়োজন মতো ফসফরাস সার (টিএসপি) প্রয়োগ করলে সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফসফরাস সার বেশি দিলে পেঁয়াজ বহুকোষী হয়ে যায়। পরিমাণমতো জিপসাম (সালফার/ক্যালসিয়াম সার) প্রয়োগ করলে পেঁয়াজে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে কন্দ দৃঢ় হয় এবং পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। বোরন জাতীয় সার প্রয়োগ করলে পেঁয়াজ দৃঢ় ও আঁটসাঁট হয়ে সংরক্ষণাগারে ভালো থাকে। জৈবসার প্রয়োগে শুষ্ক পদার্থ বৃদ্ধির মাধ্যমে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । ফলে পারতপক্ষে পেঁয়াজের জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা খুবই ভালো।
প্রশ্ন ৬ :- পিঁয়াজে কখন, কিভাবে সেচ দিতে হবে ?
উত্তর ঃ- জমির ধরন ও আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে পেঁয়াজের জমিতে ৪-৫ টি সেচ দিতে হয়। অতিরিক্ত সেচ দিলে অথবা মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহের ১৫-২০ দিন আগে সেচ বন্ধ না করলে পেঁয়াজের গলা পচা (Neck rot) রোগের মাধ্যমে পচনের হার বেড়ে যায়। পেঁয়াজ সংগ্রহের সময় পানি পেলে ঐ পেঁয়াজ সহজেই অংকুরোদগম হয়ে যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত সেচের কারণে গলা মোটা হয়ে যায়। আবার পেঁয়াজে সেচের পরিমাণ কম হলে পেঁয়াজের অংকুরোদগম হার বেড়ে যায় এবং পেঁয়াজ ফেটে গিয়ে সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে যায়। নালা সেচ পদ্ধতির তুলনায় প্লাবন সেচে রোগবালাইর পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে স্টোরে পেঁয়াজ পচনের হার বেশি হয়। তবে ড্রিপ (Drip) সেচ পদ্ধতি পিঁয়াজ চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো ।
প্রশ্ন ৭ :- পিঁয়াজের আর কিকি পরিচর্যা করতে হবে ?
উত্তর ঃ- রোগ বালাই ঃ- পেঁয়াজে পারপেল ব্লচ, গোড়া পচা রোগ হতে পারে। এসব দমনের জন্য রিডোমিল গোল্ড, ডায়থেন এম-৪৫, রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি জাতীয় ছত্রাকনাশক ওষুধ ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
আগাছা দমনঃ পেঁয়াজের জমিতে প্রচুর আগাছা জন্মে। তাই চারা লাগানোর পর প্রথম ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে প্রথমবার আগাছা পরিস্কার করতে হয়। এই ভাবে মোট ৩ থেকে ৪ বার আগাছা পরিস্কার করার প্রয়োজন হয়। আগাছা পরিস্কারের জন্য ছোট কোদাল / নিড়ানী ব্যবহার করা ভালো ।
জমিতে খড় বিছানোঃ পেঁয়াজের জমিতে মাটির জোঁ আসার সাথে সাথে ভালভাবে জমিতে খড় বিছিয়ে চটা ভেংগে দিতে হয়।
প্রশ্ন ৮ :- পিয়াজ কি ভাবে কখন সংগ্রহ ও সংররক্ষণ করতে হবে ?
উত্তর ঃ- সংগ্রহের সময়ঃ- পেঁয়াজ গাছের ঘাড় বা গলা শুকিয়ে ভেঙ্গে গেলে বা নরম মনে হলে বুঝতে হবে যে পেঁয়াজের উত্তোলনের সময় হয়েছে।পেঁয়াজ গাছ পরিপক্ক হলে পাতা ক্রমান্বয়ে হলুদ হয়ে হেলে পড়ে। জমির প্রায় ৭০-৮০% গাছের এ অবস্থা হলে পেঁয়াজ তোলার উপযোগী বীজ বপন থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় ১১০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে।
সংরক্ষণ ঃ- রবি পেঁয়াজে পানির পরিমাণ কম থাকে বিধায় দীর্ঘ দিন (৮-৯ মাস) সংরক্ষণ করা যায়। এ সময়ে রবি পেঁয়াজের প্রায় ৩০-৪০% নষ্ট হয়ে যায়। খরিপ মৌসুমে উৎপাদিত পেঁয়াজে স্বভাবতই পানির পরিমাণ বেশি থাকে।স্টোরে এ মৌসুমের পেঁয়াজের অংকুরোদগম ও পচন হার খুবই বেশি। এ পেঁয়াজ ১.৫-২.০ মাস সংরক্ষণ করলে প্রায় ৫০-৬০% পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।তাই খরিপ পেঁয়াজ সংরক্ষণ না করে বাজারজাত করাই ভালো ।
ফলনঃ- সাধারণতঃ বর্ষা মৌসুমে ৩৫-৪৫ দিন এবং রবি মৌসুমে ৪০-৫৫ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ তোলার উপযুক্ত হয়। রবি মৌসুমে পেঁয়াজের পাতা মরে গেলে (গলা চিকন হলে) গাছ সমেত পেঁয়াজ তুলে এনে পাতা শুকিয়ে মরা পাতা কেটে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ফলন রবিতে ১২-১৬ টন ও খরিপ ১০-১২ টন।