ঘৃতকুমারীর চাষ ও এর ঔষধী গুনাগুন

ঘৃতকুমারী একটি ঔষধী গূণ সম্পন্ন উদ্ভিদ। আধুনিক প্রযুক্তি ও সঠিক নিয়ম মেনে ঘৃতকুমারীর চাষ করে  কৃষক অনেক  লাভবান হতে পারে । ঘৃতকুমারীর গাছের গোড়া থেকেই সবুজ রঙের পাতা হয় এবং পাতাগুলো পুরু ধরনের হয় যার দুই পাশেই করাতের মতো ছোট ছোট কাঁটা থাকে।ঘৃতকুমারী দেখতে অনেকটা আনারস গাছের মতো।

প্রশ্ন ঃ- ০১/   ঘৃতকুমারীর কি কি উপকারীতা/ঔষধী গূণাগূণ আছে ?

উত্তর ঃ- সু-প্রাচীন কাল থেকে ঘৃতকুমারী বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঘৃতকুমারীতে রয়েছে ২০ রকমের খনিজ। মানবদেহের জন্য যে ২২টা এমিনো এসিড প্রয়োজন তার ৮ টি এতে বিদ্যমান। এছাড়াও ভিটামিন A, B1, B2, B6, B12, C এবং E রয়েছে। পাতার ভেতরে স্বচ্ছ পিচ্ছিল ধরনের শাঁস থাকে যাকে ঘৃতকুমারীর জেল বলা হয়। এই জেল বা জেলী বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।

এছাড়া ও অনেক ঔষধী গূণ আছে যেমন :-

* ঘৃতকুমারীর রস নিয়মিত পান করলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে দেহের পরিপাকতন্ত্র সতেজ থাকে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে থাকে।

* নিয়মিত ঘৃতকুমারীর রস পান করলে শরীরের শক্তি বাড়ানোসহ ওজনকে নিয়ন্ত্রণে  রাখতে সাহায্য করে।

* ঘৃতকুমারী মানবদেহে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

* ঘৃতকুমারীর রস ব্যবহারের ফলে শরীরে বিভিন্ন  ধরনের ভিটামিনের মিশ্রণ ও খনিজ পদার্থ তৈরি হয় যা আমাদেরকে চাপমুক্ত রাখতে এবং শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। ঘৃতকুমারীর রস হাড় ও মাংশপেশির জোড়াগুলোকে শক্তিশালী করে। সেই সাথে শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ প্রশমনে ও ভূমিকা রাখে।

* ঘৃতকুমারীর  পাতা, মধু ও একটি ছোট শসা  একত্রে পেষ্ট  করে মোখে মেছতার ওপর লাগিয়ে রাখলে মেছতা দূর হয়।

* ঘৃতকুমারী চুলের উজ্জলতা বাড়াতে কন্ডিশনারের কাজ করে।এছাড়া চুল পড়া এবং খুশকি প্রতিরোধ করে ।

* মাথা যদি সব সময় গরম থাকে তাহলে পাতার শাঁস প্রতিদিন একবার তালুতে নিয়ম করে লাগালে মাথা ঠাণ্ডা হয়।

প্রশ্ন ঃ- ০২/ ঘৃতকুমারী চাষের প্রয়োজনীয়তা ও অর্থনৈতিক গূরূত্ব সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেন ?

উত্তর ঃ- ঘৃতকুমারী একটি সুপরিচিত গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ ঔষধি গাছ। ঘৃতকুমারী বিভিন্ন ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া একটি গাছ থেকে অর্থাৎ গাছের পাতা থেকে অনেকগুলো চারা/গাছ জন্মায়। এর পর উপযুক্ত সময় গাছের পাতা কেটে তা বিক্রয় করা যাবে। তেমন কোন পরিচর্যার দরকার হয় না। তবে বেশি তাপে গাছ মরে যেতে পারে। এক বিঘা জমিতে প্রায় তিন হাজার ছয়শো (৩৬০০)টি গাছ লাগানো যায়। এক বিঘা জমিতে বছরে খরচ প্রায় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। ঘৃতকুমারী চারা লাগানোর দুই তিন মাস পর থেকেই গাছের পাতা তোলা শুরু করা যায়। একটি গাছ থেকে ৬০ থেকে ৭০ টির মতো পাতা বিক্রি করা যায় এবং সারা বছর জুড়ে এর থেকে নতুন নতুন পাতা জন্মে । বছরে ৯-১০ মাস পাতা তোলা যায়। শীতকালে পাতা তোলা বন্ধ থাকে। সাধারণত প্রতি ১৫ দিনে একটি পাতা বের হয়। তবে চাষিরা মাসে একটি গাছ থেকে ১-২টি পাতা সংগ্রহ করে। গাছের বৃদ্ধি ও পাতা বড় হলে প্রতি মাসে দু’টি পাতা তোলা যায় । প্রচুর চাহিদা থাকার কারনে বাজারজাত করতে সমস্যা হচ্ছে না। পাতা তোলার পর পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় শুকিয়ে আঁটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করা যায়। ১ বিঘা জমি হতে ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকার পাতা বিক্রি করা যায়। সঠিক পদ্ধতিতে ঘৃতকুমারী চাষ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে  বিদেশে ও রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

প্রশ্ন ঃ- ০৩/   ঘৃতকুমারী চাষ করতে হলে কেমন  জমি ও আবহাওয়া  প্রয়োজন?

উত্তর ঃ-  জমি প্রস্তুত করে নিয়ম অনুযায়ী ঘৃত কুমারি চাষ করতে হয়।  প্রায় সবরকম জমিতেই ঘৃতকুমারী চাষ সম্ভব; তবে দোঁ-আশ ও অল্প বালু মিশ্রিত মাটিতে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয় । যেকোনো দোআঁশ মাটিতে চাষ ভালো হয় তবে বেলে দোআঁশ মাটি উত্তম। এঁটেল মাটিতে চাষ না করা ভালো। সুনিষ্কাশিত জমি যেসব জমিতে পানি জমে না এরূপ উঁচু জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষ করা যায়। তবে লবণাক্ত ও চরম অম্লীয় মাটিতে এর চাষ ভালো হয় না। নিচু ও পানি জমা জমিতে গাছ পচে যায়। ছায়াযুক্ত জায়গায় হবে না, ঘৃতকুমারীর জন্য দরকার সারা দিন রোদ।

প্রশ্ন ঃ- ০৪/  ঘৃত কুমারী চাষ করতে হলে কিকি সার দিতে হবে ?

উত্তর ঃ-  ঘৃতকুমারী চাষ করতে হলে জমি প্রথমে ভালোভাবে পরিষ্কার করে চাষ দিতে হবে। সাধারণত কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহার করতে হবে খৈল বা নিম খৈলের মত জৈব সার। চাষের সময় বিঘা প্রতি ১ থেকে ১.৫ টন গোবর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া চাষের  সময় বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ কেজি টিএসপি ও ১৫ থেকে ২০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে। ঘৃতকুমারী চাষে সাধারণত বেশি করে গোবর সার দিয়ে এর চাষ করা যায়। তবে শুধু প্রচুর ছাই ব্যবহার করে  এর চাষ করা যায়। ইউরিয়া সার বছরে  একবার সবটুকু জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে জমিতে ছিটিয়ে দিলেই চলে। সার ছিটানোর পর আগাছা নিড়িয়ে মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিতে হয়। বেশি ইউরিয়া সার দিলে রোগের আক্রমণ ও প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই রাসায়নিক সার ব্যবহারের সময় সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।

প্রশ্ন ঃ- ০৫/  ঘৃতকুমারীর  চারা কখন  লাগাতে হবে ?

উত্তর ঃ-  বছরের যেকোনো সময় ঘৃতকুমারীর চারা লাগানো যায়। জুন- জুলাই(আষাঢ়) মাসের শুরুতে গাছ লাগালে তখন গাছ  সবচেয়ে দ্রুত বাড়ে। তবে শীত কালে চারা না লাগানো ভালো। সাধারণত কার্তিক -অগ্রহায়ণ মাসে চারা বেশি লাগানো হয়। এ সময় চারা লাগালে শীতের মধ্যে গাছ মাটিতে লেগে যায়। শীতের সময় বাজারে ঘৃতকুমারীর পাতার চাহিদা থাকে না। তাই এ সময় পাতা সংগ্রহ থেকে বিরত থাকতে হবে। পক্ষান্তরে এই ২-৩ মাসের মধ্যে চারা জমিতে ভালোভাবে লেগে যায়। শীত শেষে বসন্তে নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করলে পাতা সংগ্রহ করা শুরু করতে হবে । এ পদ্ধতিতে চাড়া রোপণ করলে বেশি পাতা পাওয়া যায়।

প্রশ্ন ঃ- ০৬/  ঘৃতকুমারীর চাষ করতে চারা কিভাবে  লাগাতে হবে ?

উত্তর ঃ- ঘৃতকুমারীর তিন রকম চারা লাগানো হয়। রুট সাকার বা মোথা, গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা ও গাছের গোড়ার অংশ কেটে ফেলে পুরো গাছ। বাণিজ্যিক ভাবে রুট সাকার লাগানো লাভজনক নয় বিধায় এটি লাগানো হয় না। বাণিজ্যিক চাষের জন্য এরূপ চারা লাগানোর চেয়ে মোথা কেটে বাদ দিয়ে সরাসরি পুরনো গাছ লাগাতে হবে। এতে দ্রুত পাতা তোলা যায় । এ রকম গাছ লাগানোর তিন মাসের মাথায় পাতা তোলা যায়। চারা সারি করে লাগানো হয়। ১.৫ মিটার চওড়া বেডে দুই সারিতে এবং ২.২৫ মিটার চওড়া বেডে তিন সারিতে চারা রোপণ করা হয়। প্রতি দুই বেডের মাঝে  ১৬-২০ ইঞ্চি নালা রাখতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭” ইঞ্চি ও চারা থেকে চারার দুরত্ব হবে  ৬”ইঞ্চি ।

প্রশ্ন ঃ- ০৭/   ঘৃতকুমারী চাষ করতে হলে কখন সেচ দিতে হবে ?

উত্তর ঃ-  সাধারনত ভেজা জমিতে ঘৃত কুমারি ভালো বাড়ে। নিয়মিত সেচের দরকার হলেও গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।শুষ্ক মৌসুমে জমিতে প্রয়োজন মাফিক সেচ দিতে হবে। মাঝে মাঝে জমির আগাছা নিড়িয়ে দিতে হবে। ঘৃতকুমারী গাছ জমিতে প্রায় দুই বছর থাকে। তাই দ্বিতীয় বছরে ও প্রথম বছরের মতো একই হারে জমিতে সার ও সেচ দিতে হবে।

প্রশ্ন ঃ- ০৮/  ঘৃতকুমারীর  রোগ ও পোকা দমন কিভাবে করতে হবে  ?

উত্তর ঃ-  লাগানো গাছ সুস্থ সবল আছে কিনা তা দেখতে হবে। ঘৃতকুমারী গাছে সাধারণত কোনো পোকামাকড় দেখা যায় না। তবে মাঝে মাঝে ছাতরা পোকা, জাব পোকা, স্কেল পোকা, লাল মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হতে পারে। পোকা দেখা দিলে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে । যেমন ঃ- ফাইটার/নাইট্রো যে কোন একটি  ২০ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন রোগ হতে পারে।  যেমন ঃ- পাতার দাগ রোগ, গোড়া পচা রোগ এ রোগ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায়  ব্যবহার করতে হবে । নাটিভো/ফলিকুর যে কোন একটি  ২০ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

প্রশ্ন ঃ- ৯ /   ঘৃতকুমারী চাষ করলে আর্থিক কি লাভবান হওয়া যায় ?

উত্তর ঃ- এক বিঘা জমিতে প্রায় তিন হাজার ছয়শো (৩৬০০)টি গাছ লাগানো যায়। একটি গাছ থেকে ৬০ থেকে ৭০ টির মতো পাতা বিক্রি করা যায়। প্র্রতিটি পাতার বিক্রয় মূল্য ১০/= টাকা হলে, একবিঘা জমিতে মোট বিক্রি হবে।

*** গাছ-৩৬০০*পাতা-৬০*টাকা-১০= ২১,৬০,০০০/=টাকা।একুশ  লক্ষ ষাট হাজার টাকা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top