গম চাষের উপযোগী জমি ও চাষ ব্যাবস্থাপনা

বাংলাদেশে উৎপাদন ও খাদ্যের দিক দিয়ে দানা ফসল হিসেবে গম ২য় স্থানে রয়েছে। অর্থাৎ ধানের পরেই গমের স্থান। স্থানীয় জাতের তুলনায় উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল প্রায় তিন গুণ বেশি হওয়ায় বর্তমানে গম উৎপাদনে বিপুল উৎসাহ সৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৯৮ সাল থেকে পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু উচ্চ ফলনশীল, তাপসহিষ্ণু ও রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে হস্তান্তরিত হওয়ায় গমের আবাদ, উৎপাদন এবং ফলন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ৪.৫৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে গমের উৎপাদন ১৩.৭৫ লক্ষ মেট্রিক টন। গমের হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৩.০৪ টন যা বাংলাদেশের গম চাষের ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক।

প্রশ্ন ০১/   কোন মাটিতে গমের চাষ করা যায় ?

উত্তরঃ-মাটির প্রকৃতিঃ –উঁচু ও মাঝারি দো-আঁশ মাটি গম চাষের জন্য বেশি উপযোগী৷ লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয় ৷ সাধারণত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি গম চাষের জন্য উপযুক্ত ৷ তবে মাঝারি নিচু জমিতেও গম চাষ হয় ৷ দোঁআশ ও বেলে-দোঁআশ মাটি গম চাষের জন্য সর্বোত্তম ৷ সহজে পানি নিষ্কাশিত হয় এমন ভারী অর্থাৎ এঁটেল ও এঁটেল-দোঁআশ মাটিতেও গমের চাষ করা যায় ৷

প্রশ্ন ০২/ আমরা কি কি জাতের গম  চাষ করতে পারি  ?

উত্তর ঃ-  জাত নির্বাচন : ভালো ফলনের জন্য নতুন উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাত গুলোই নির্বাচন করা উচিত। বারিগম ১৯ (সৌরভ), বারিগম ২০ (গৌরব), বারিগম ২১ (শতাব্দী), বারিগম ২২ (সুফি), বারিগম ২৩ (বিজয়), বারিগম ২৪ (প্রদীপ)- এই জাত গুলো হলো তাপসহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল জাত। এছাড়াও বারিগম ২৫ হলো লবনাক্ততা সহিষ্ণু, তাপসহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল জাত, বারিগম ২৬ হলো উচ্চ ফলনশীল ও তাপ সহিষ্ণু জাত। এটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল ও পাতার মরিচা রোগ প্রতিরোধী জাত। বারিগম ২৭ একটি উচ্চ ফলনশীল স্বল্প মেয়াদি গমের জাত, যা পাতার দাগ রোগ প্রতিরোধী। বারিগম ২৮ হলো স্বল্প মেয়াদি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। বারিগম ২৯ একটি তাপ সহনশীল উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। বারিগম ৩০ হলো তাপ সহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল গমের জাত, যা পাতার দাগ রোগ সহনশীল ও পাতার মরিচা রোগ প্রতিরোধী জাত। বারিগম ৩১  এবং বারিগম ৩২ হলো তাপ সহনশীল উচ্চ ফলনশীল গমের জাত, যা আমন ধান কাটার পর দেরিতে রোপণের জন্য উপযোগী। বারিগম ৩৩ একটি তাপ সহনশীল উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। এই জাত টি গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত।

প্রশ্ন ০৩/ গমের বীজ কোন সময়ে বপন করতে হবে ?

উত্তরঃবপনের সময়ঃ- গম রবি মৌসুমের ফসল। গম বীজ বপনের  উপযুক্ত সময় হলো অগ্রহায়ণ মাসের ১ম থেকে ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত (নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত )। তবে তাপ সহনশীল জাত ডিসেম্বার মাসের ১৫-২০ তারিখের মধ্যে বুনলে ও অন্যান্য জাতের তুলনায় বেশি ফলন দেয়। যেসব এলাকায় ধান কাটতে ও জমি তৈরী করতে বিলম্ব হয় সে ক্ষেত্রে  কাঞ্চন, আকবর , অঘ্রাণী, ও গৌরব বপন করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

## বীজ শোধনঃ প্রোভেক্স/ভিটাভেক্স ২০০ প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধনের ফলে চারা সবল ও সতেজ হয় এবং গম গজানোর হার ও ফলন বৃদ্ধি পায়। বীজ শোধন করলে শতকরা ১০-১২ % ফলন বৃদ্ধি পায়।

## বীজের হারঃ  হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। বীজ গজানোর ক্ষমতা ৮০% এর বেশী  হলে ভালো হয়। বীজ জমিতে বপনের পূর্বে অঙ্কুরোদগম হার পরীক্ষা করে নিতে হবে।

প্রশ্ন ০৪/ গম  বীজ বপন  পদ্ধতি কি কি ?

উত্তর ঃ- বপন পদ্ধতিঃ সারিতে বা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরীর পর লাংগল দিয়ে সরু নালা তৈরী করে ২০ সেমি বা ৮ইঞ্চি দূরে দূরে সারিতে এবং ৪-৫ সেমি গভীরে বীজ বপন করতে হবে। আগাম বপনের জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে গম আবাদ করা যায়। যন্ত্রটির সুবিধা হলো ধান কাটার পর পর একই সময়ে চাষ, বীজ বপন ও মই দেওয়ার কাজ করা যাবে। যন্ত্রটিতে ২০ কেজি বীজ রাখার মতো একটি হপার থাকে এবং ২০ সেমি. দূরে দূরে ৬ সারিতে ৩-৪ সেমি. গভীরে বীজ বোনা যায়। বীজ বোনার সঙ্গে সঙ্গে বীজ ঢেকে দেয়া হয়  বলে পাখি কম ক্ষতি করে এবং শতকরা প্রায় ২০ ভাগ বীজের সাশ্রয় হয়।

প্রশ্ন ০৫/ গম  চাষে  রাসায়নিক সার কি কপরিমান প্রয়োজন ?

উত্তর ঃ-সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতিঃ সেচ সহ চাষের ক্ষেত্রে নির্ধারিত  ইউরিয়া সারের  দুই-তৃতীয়াংশ এবং সম্পূর্ন টিএসপি, এমওপি ও জিপসাম শেষ চাষের পূর্বে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে  হবে। বাকী এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া চারার তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি হেক্টরে ৬০-৭০ কেজি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সমস্ত ইউরিয়া শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। তবে সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির পর জমি ভেজা থাকা অবস্থায় উপরি প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত ইউরিয়া প্রয়োগ করা ভালো।

# গম  চাষে নিম্ন লিখিত হারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে  ঃ-

  সারের নামসারের পরিমাণ/ হেক্টর
সেচ সহ (কেজি)সেচ ছাড়া (কেজি)
ইউরিয়া১৮০-২২০ কেজি১৪০-১৮০  কেজি
টিএসপি১৪০-১৮০ কেজি১৪০-১৮০ কেজি
এমপি৪০-৫০    কেজি৩০-৪০    কেজি
জিপসাম১১০-১২০ কেজি৭০-৯০    কেজি
গোবর/কম্পোস্ট (টন)৭-১০     (টন)৭-১০      (টন)

*** জমিতে প্রায়শ বোরন সারের ঘাটতি দেখা যায় বলে প্রতি হেক্টরে ৬.৫ কেজি হারে বরিক এসিড শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। যে সব জমিতে দস্তা সারের  ঘাটতি রয়েছে এবং পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা প্রয়োগ করা হয়নি সে সব জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টর প্রতি ১২.৫ কেজি দস্তা সার যথা জিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট শতকরা ৩৬ ভাগ জিংক সম্বলিত) শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করা ভালো। জমিতে অম্লীয় মাত্রা ৫.৫ এর নিচে হলে হেক্টর প্রতি ১০০০ কেজি হারে ডলোচুন গম বপনের কম পক্ষে দু’সপ্তাহ আগে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ৩ বছরে এক বার ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে।

প্রশ্ন ০৬/ গম চাষের আর কি কি পরিচর্যা করতে হয়?

উত্তর ঃ- অন্যান্য পরিচর্যাঃ সেচ প্রদানঃ মাটির প্রকার ভেদে গম আবাদে ২-৩ টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পর), দ্বিতীয় সেচ শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর) এবং তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে। তবে মাটির প্রকার ভেদে ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো ফলনের জন্য অতিরিক্ত এক বা একাধিক সেচ দেওয়া ভালো। প্রথম সেচ টি খুবই হালকা ভাবে দিতে হবে।  তা না হলে অতিরিক্ত পানিতে চারার পাতা হলুদ এবং চারা সম্পূর্ণ বা আংশিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেচের পর পরই জমি থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে। তাই বপনের পর জমির ঢাল বুঝে ২০-২৫ ফুট অন্তর নালা কেটে রাখতে হবে।

## আগাছা দমনঃ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে জমিতে ‘জো’ অবস্থায় আগাছা দমনের জন্য নিড়ানী দিতে হবে। নিড়ানীর ফলে মাটি আলগা হবে এবং আর্দ্রতা বজায় থাকবে। চওড়া পাতা জাতীয় আগাছা (বথুয়া ও কাকরি) দমনের জন্য ২,৪ ডি এমাইন বা এফিনিটি জাতীয় আগাছা দমন কারী ঔষধ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৩৫ মিলি লিটার হিসেবে ভাল ভাবে মিশিয়ে স্প্রে মেশিনের সাহায্যে মেঘ মুক্ত দিনে এক বার প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। সময় মত আগাছা দমন করলে ফলন শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়।

## পাখি তাড়ানো: বীজ বপনের পর ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

## চিটা ব্যবস্থাপনা: উত্তরাঞ্চলের মাটিতে মাঝে মাঝে গমে চিটা দেখা যায় এবং এর ফলে ফলন কমে যায়। অনুমোদিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং বিঘা প্রতি ৮০০ গ্রাম বরিক এসিড বা ১ কেজি ৩০০ গ্রাম বোরাক্স প্রয়োগ করে চিটা দুর করা যায়।

*** আধুনিক পদ্ধতিতে নিয়ম মেনে গম চাষ করে আমরা যেমন দানা জাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়াতে পারি, আবার খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারি ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top