ফুলকপি ও বাঁধাকপি ক্ষেতে চাষ ব্যাবস্থাপনা

বাংলাদেশে প্রায় এক’শ রকমের ফসল জন্মে। এর মধ্যে সবজি জাতীয় ফসলই বেশি। সবজি ফসলের মধ্যে বেগুন, আলু, টমেটো, শিম, বরবটি,লাউ,মিষ্টিকুমড়া,চালকুমড়া,চিচিঙ্গা,করলা,ঝিঙ্গা,বাঁধাকপি,ফুলকপি, ঢেঁড়শ, মূলা,গাজর ইত্যাদি। এর ভেতরে কিছু সবজি আছে যা সারা বছরই জন্মে । আবার কিছু মৌসুমী সবজি আছে যা জন্মে গ্রীষ্মকালে এবং শীতকালে। চারিদিকে চলছে শীতকালীন সবজি চাষের তোড়জোর। শীতকালীন সবজির মধ্যে রয়েছে – ফুলকপিবাঁধাকপিটমেটো, মটরশুটি, পালনশাক, শিম, ডাটাশাক, মূলা,গাজর ইত্যাদি।আজ আমরা ফুলকপি ও বাধাকপি ক্ষেতে সার এবং সেচ ব্যাবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করব।

প্রশ্ন ০১/  আমরা ফুলকপির কিকি  জাত চাষ করতে পারি ?

উত্তর ঃ- আমাদের দেশে এখন ফুলকপির পঞ্চাশটিরও বেশি জাত পাওয়া যাচ্ছে। শীতকালেই আগাম, মধ্যম ও নাবি মৌসুমের বিভিন্ন জাতের ফুলকপি আবাদ করা যায় ।

আগাম ফুলকপির জাতগুলো হলো – অগ্রহায়ণী, আর্লি পাটনা, আর্লি স্নোবল, সুপার স্নোবল, ট্রপিক্যাল স্নো ৫৫, সামার ডায়মন্ড এফ১, ম্যাজিক স্নো ৫০ দিন এফ১, হোয়াইট বিউটি, কেএস ৬০, আর্লি বোনাস, হিট মাস্টার, ক্যামেলিয়া, আর্লি মার্কেট এফ১, স্পেশাল ৪৫ এফ১, স্নো কুইন এফ১ ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বপন করতে হবে ।

মধ্যম মৌসুমের  জাতগুলো হলো – বারি ফুলকপি ১ (রূপা), চম্পাবতী ৬০ দিন, চন্দ্রমুখী, পৌষালী, রুপসী, স্নোবল এক্স, স্নোবল ওয়াই, হোয়াইট টপ, স্নো ওয়েভ, মোনালিসা এফ১, ম্যাজিক ৭০ এফ১, বিগটপ, চন্দ্রিমা ৬০ এফ১, হোয়াইট ফ্যাশ, বিগশট, হোয়াইট কনটেসা ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বপন করতে হবে।

নাবি জাতের ফুলকপি  – মাঘী, বেনারসি, ইউনিক স্নোবল, হোয়াইট মাউন্টেন, এরফার্ট ইত্যাদি জাত লাগানো যেতে পারে। এসব জাতের বীজ আশ্বিন-কার্তিক মাসে বপন করতে হবে।

প্রশ্ন ০২/  আমরা বাঁধাকপির কিকি  জাত চাষ করতে পারি ?

উত্তর ঃ- বাঁধাকপির জাত সমুহ ঃ- আমাদের দেশে বাঁধাকপি চাষের জন্য নানান ধরনের জাত রয়েছে। এ সকল জাতগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

আগাম জাত ঃ- কে কে ক্রস,ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস,এফ-১,সুপার গ্রীন এফ-১, রেসি ৬৫ এফ-১, ইপসা বাধাকপি-১।
মধ্যম জাত ঃ- এটলাস ৭০ , কে ওয়াই ক্রস, টোকিও প্রাইড, গ্রীন এক্সপ্রেস, প্রভাতী ইত্যাদি।

নাবী জাত ঃ- লিও ৮০, সেভয়, রুবি বল, ড্রাম হেড ইত্যাদি জাত গুলো ।

### বীজ উৎপাদন করতে চাইলে যে সকল  জাত লাগাতে হবে ঃ- বারি বাঁধাকপি-১ (প্রভাতী),বারি বাঁধাকপি-২ (অগ্রদূত), ইপসা বাঁধাকপি ১ ,ইত্যাদি জাতগুলো বীজের জন্য ভালো ।
 

প্রশ্ন ০৩/  ফুলকপি ও বাঁধাকপির জন্য  কি ভাবে  জমি তৈরী করতে  হবে ?

উত্তর ঃ- জমি তৈরি  ঃ- পানি নিষ্কাশন  সুবিধাযুক্ত উঁচু জমিতে গভীর ভাবে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে। বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর সুস্থ ও সবল  চারা বা ৫/৬টি পাতা বিশিষ্ট ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা  চারা সাধারণতঃ বিকেল বেলা জমিতে রোপণ করতে হয়। এ হিসেবে প্রতি শতকে ১৫০টির মত চারার প্রয়োজন হয়। আঙ্গিনায় ৫ মিটার লম্বা একটা বেডের জন্য ২০-২২টি চারার প্রয়োজন হয়। বেডে দুই সারিতে চারাগুলো লাগাতে হবে।  

প্রশ্ন ০৪/ ফুলকপি ও বাঁধাকপি  চারা  কি ভাবে তৈরী করতে  হবে ?

উত্তর ঃ- চারা তৈরি/বীজ বপন: ফুলকপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে জমিতে লাগানো হয়। বীজতলার আকার এক মিটার পাশে ও লম্বায় তিন মিটার হতে হবে। সমপরিমাণ বালু, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরঝুরা করে বীজতলা তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা রোপণের আগে সাত থেকে আট দিন আগে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরে চারা ঠিকমতো না বাড়লে প্রতি বীজতলায় প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেয়া ভালো। প্রতি শতক জমিতে ফুলকপি চাষের জন্য এ রকম একখন্ড বীজতলায় ২ থেকে ২.৫ গ্রাম বীজ বুনলেই চলবে।

প্রশ্ন ০৫/  ফুলকপি ও  বাঁধাকপি  চারা রোপণ কি ভাবে করতে  হবে ?

চারা রোপণ : বীজ গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়। চারায় পাঁচ থেকে ছয়টি পাতা হলেই তা রোপণের উপযুক্ত হয় । সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ দিন বয়সের চারা রোপণ করা হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ ইঞ্চি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব  ১৬ ইঞ্চি। চারা রোপণের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন শিকড় মুচড়ে বা বেঁকে না যায়। এতে চারা  মাটিতে লাগতে দেরি হয় ও বৃদ্ধি কমে যায়।

প্রশ্ন ০৬/  ফুলকপি ও বাঁধাকপি ক্ষেতে কি পরিমানে সার দিতে হবে ?

উত্তর ঃ- কপি চাষের জন্য মাঝারি উর্বর মাটিতে হেক্টর প্রতি ৩০০-৩৫০ কেজি ইউরিয়া, ১৩০-১৫০ কেজি টিএসপি, ১৫০-২০০ কেজি এমপি এবং ৫-৭ টন গোবর সার প্রয়োগ করাতে হবে । এছাড়া অম্ল মাটিতে ৪০০-৭০০ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর, সমুদয় টিএসপি ও অর্ধেক এমপি সার প্রয়োগ করতে হয়। বাকি অর্ধেক গোবর চারা রোপণের এক সপ্তাহ আগে মাদায় দিয়ে মিশিয়ে রাখতে হয়। ইউরিয়া এবং বাকি অর্ধেক এমপি সার তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়। চারা লাগানোর ৮-১০ দিন পর প্রথম কিস্তি এবং চারা লাগানোর ৩০-৫০ দিন পর অবশিষ্ট সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

প্রশ্ন ০৭/  ফুলকপি ও  বাঁধাকপি ক্ষেতে কখন কিভাবে সেচদিতে  হবে ?

উত্তর ঃ- সার দেয়ার পর পরই কপি ক্ষেতে সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া ২-৩ দিন পর পরই সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া জমি শুকিয়ে গেলে সেচ দিতে হবে। জমিতে পানি বেশি সময় ধরে যেন জমে না থাকে সেটাও খেয়াল করতে হবে। গাছ বড় হবার সাথে সাথে দুই সারির মাঝখান থেকে মাটি তুলে সারি বরাবর আইলের মত করে দিতে হবে। ফলে  দু’সারির মাঝে নালা তৈরি হবে। এতে সেচ দিতে বেশ সুবিধে হবে। সার দেয়ার আগে নিড়ানী দিয়ে মাটির আস্তর ভেঙে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।

প্রশ্ন ০৮/  ফুলকপি ও  বাঁধাকপি ক্ষেতে আর কি কি পরিচর্যা করতে হবে ?

উত্তর ঃ-  প্রথম ও দ্বিতীয় বার সার উপরি প্রয়োগের পর পরই সারির দু’পাশের মাটি আলগা করে গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। এতে সেচ ও নিষ্কাশন উভয় কাজে সুবিধা হবে।  

বিশেষ পরিচর্যা : ফুলকপি গাছের সারির মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝ খানের মাটি তুলে দু’পাশ থেকে গাছের গোড়ায় টেনে দিতে হবে। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। তবে ফুলকপির ফুল সাদা রাখার জন্য কচি অবস্থায় চার দিক থেকে পাতা টেনে বেঁধে ফুল ঢেকে দিতে হবে। সূর্যের আলো সরাসরি ফুলে পড়লে ফুলের রঙ তথা ফুলকপির রঙ হলুদাভ হয়ে যাবে।

আবশ্যকীয় কার্যাবলী:
১.পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু জমিতে চাষ করতে হবে।
২.আগাছা দমন করতে হবে।
৩.সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪.রোগ-বালাই দমনে উপযুক্ত ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫.অবশ্যই সোহাগা ব্যবহার করতে হবে।

৬.সঠিক বয়সের সুস্থ ও সবল চারা স্থানান্তর,পরিমিত সার, সেচ ও অন্যান্য অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সঠিক সময় ও নিয়মে অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে।

প্রশ্ন ০৯/ ফুলকপি ও বাঁধাকপি ক্ষেতে  পোকা ও রোগ দমন  কি ভাবে করতে হবে ?

উত্তর ঃ-  ফুলকপির সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হলো মাথাখেকো লেদা পোকা। নাবি জাতের কপিতে  সরুই পোকা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ বেশি ক্ষতি করে। বীজ উৎপাদনের জন্য চাষ করলে পুষ্পমঞ্জরীকে জাব পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যান্য পোকার মধ্যে লেদা পোকা, কালো ও হলুদ বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা ইত্যাদি মাঝে মাঝে ক্ষতি করে থাকে এর জন্য অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক নাইট্রো/ডারসবান ২ মিঃলিঃ/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফুলকপির পাতায় দাগ ও কালো পচা রোগ প্রধান সমস্যা।এ ছাড়া চারা ধসা বা ড্যাম্পিং অফ, কাব রুট বা গদাই মূল, মোজাইক, পাতার আগা পোড়া ইত্যাদি রোগও হয়ে থাকে এর জন্য অনুমোদিত মাত্রায় ছত্রাকনাশক ডাইথেন এম-৪৫/ নুইন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে  স্প্রে করতে হবে। বোরন সারের অভাবে ফুলে বাদামি দাগ পড়ে ও কপি ফাঁপা হয়ে যায় এর জন্য বোরন প্রয়োগ করতে হবে।

প্রশ্ন ১০/ ফুলকপি ও বাঁধাকপি ফলণ কি পরিমান  হবে ?

উত্তর ঃ- ফসল তোলা ও ফলন :  চারা রোপণের ৪৫ দিন পর কপি সংগ্রহ করতে হয়। সাদা রঙ ও আঁটসাঁট থাকতে থাকতেই ফুলকপি তুলে ফেলা উচিত। মাথা ঢিলা ও রঙ হলদে ভাব ধরলে দাম কমে যায় তাই খেয়াল করে ফসল তুলতে হবে । একরপ্রতি ফলন ১৫ থেকে ২৫ টন, হেক্টরে ৩৫ থেকে ৬০ টন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top