স্বাধীনতার পর পরই সদ্য স্বাধীন দেশের ৩০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল,আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ধান উৎপাদনে বোরো মৌসুম সর্বাধিক উৎপাদনশীল। একথা অনস্বীকার্য বোরোর ওপর ভিত্তি করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি রচিত হয়েছে। দেশের মোট উৎপাদনের ৫৮ ভাগ আসে এ মৌসুম থেকে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোরো ধানের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৫ থেকে ২.০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব যা জাতীয় উৎপাদনে বিশাল ভুমিকা রাখতে পারে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুনর্নিমাণ ও কৃষি-যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজারটি শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, ২৯০০টি গভীর নলকূপ ও ৩০০০ টি অগভীর নলকুপ স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশে বোরো আবাদ বাড়ানোর ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন ০১/ ভাইজান বোর ধান চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে বলেন ?
উত্তর ঃ- গত ২০ বছরের বোরো ধান চাষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কৃষকরা বোরো ধান চাষ করে প্রতি বছর আনুপাতিক হারে লাভ করছেন। যদিও কোন কোন বছরে লাভের তারতম্য আছে, কিন্তু কৃষকরা সাধারণত বোরো ধান অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষ করেন। যা দিয়ে তারা খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে প্রয়োজন মাফিক বিক্রি করে দৈনন্দিন আর্থিক চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। কৃষকদের আয়ের একটি বড় অংশ বোরো ধান থেকে আসে। যদি বোরো ধান চাষ না করা হয় তাহলে কৃষকের আয় অনেকাংশে কমে যাবে এবং তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বোরো ধান চাষ অত্যন্ত জরুরি।
প্রশ্ন ০২/ ভাইজান বোর ধান চাষে আগাছা দমন সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে বলেন ?
উত্তর ঃ- সঠিক সময়ে আগাছা দমন না করলে বোরো মৌসুমে প্রায় ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যায়। বোরো মৌসুমে চারা লাগানোর পর দুই/তিন বার আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। বোর ধান চাষে ৩/৪ বার আগাছা দমন করতে হবে । ১ম বার চারা লাগানোর ১৫/২০ দিনের মধ্যে, ২য় বার চারা লাগানোর ৩৫/৪৫ দিনের মধ্যে, ৩য় বার চারা লাগানোর ৬০/৭০ দিনের মধ্যে, এবং ৪র্থ বার ধান কাটার ১৫/২০ দিন পূর্বে । অথবা বাজারে এখন অনেক আগাছানাশক পাওয়া যায় ,এদের যে কোন একটি প্রয়োগ করে আগাছা দমন করা যায়। বোরো মৌসুমে আগাছা দমনের ক্রান্তিকাল হল চারা রোপণ হতে ৪৫-৫০ দিন পর্যন্ত ধানক্ষেত আগাছা মুক্ত রাখতে পারলে ফসলের ক্ষতি হবে না। কিন্তু অনেক সময় কৃষকরা সঠিক সময়ে আগাছা দমন না করায় আগাছা ধান গাছের সাথে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা করে ধানের ফলন কমিয়ে দেয়। বোরো মৌসুমে চারা লাগানোর অন্তত ৪৫ দিন পর্যন্ত জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
প্রশ্ন ০৩/ ভাইজান বোর ধান চাষে সারের মাত্রা ও সার প্রয়োগ সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে বলেন ?
উত্তর ঃ- উৎপাদন বৃদ্বির জন্য সঠিক সময় এবং সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। বিঘাপ্রতি অর্থাৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১৩ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ১৫ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। তবে টিএসপির বদলে ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে।
*** হাওর অঞ্চলের জাতের ক্ষেত্রে প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ২৭ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি।
*** টিএসপি বা ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সারের পুরোটাই শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। এবং সতর্ক থাকতে হবে দস্তা ও টিএসপি একসাথে না মিশিয়ে পৃথকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া সারকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে দিতে হবে ।
*** সার প্রয়োগ ও পদ্ধতি নিয়ে আরও কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে। জমিতে পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সারের সাথে রাসায়নিক সার সমন্বয় করে ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় ও ভালো ফলন হয়। জমিতে বছরে একবার হলেও বিঘাপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
*** এছাড়া ধান কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ১০-১২ ইঞ্চি ওপরে কেটে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে দিলে পটাশ সারের পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগ কম লাগে। দস্তা বা জিঙ্ক সালফেট সার ফসলচক্রের কোন একটিতে ব্যবহার করলে তা পরবর্তী দুই ফসলের জন্য ব্যবহার না করলেও চলবে। বেলে মাটিতে চার কিস্তিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করাই ভালো। জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার সমভাবে ছিটানোর পর হাতড়িয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলে ভালো ফলন আশা করা যায়। তীব্র শীতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা যাবে না।
প্রশ্ন ০৪/ ভাইজান বোর ধান চাষে সেচ প্রয়োগ সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে বলেন ?
উত্তর ঃ- মনে রাখতে হবে ধান গাছ কোনো জলজ উদ্ভিদ নয় তবে পানি বেশি পছন্দ করে। এজন্য সারাক্ষণ পানিতে ভাসিয়ে জমি টইটম্বুর করে রাখা ঠিক নয়। পানি বেশি হলে বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগ, রোগের জীবাণু ছড়ায়, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল/ফল ঝড়ে পড়ে ও দানা পুষ্ট হয় না। পরিশেষে ফলন কম হয়। আবার অন্যদিকে পানি কম হলে খাদ্য গ্রহণ বা পরিবহনে ব্যাহত হয়, খাদ্য তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়, গাছ মরে যেতে পারে, ফুল-ফল দেরিতে আসে, আগাছা বেশি হয় এবং দানা পুষ্ট হয় না। ফলশ্রুতিতে ফলন কম হয়। ধানের বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কী পরিমাণ পানি লাগে তা জেনে সেচ দিতে হবে। চারা লাগানোর সময় ছিপছিপে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পানি লাগে। এর কম বা বেশি হলে রোপণে অসুবিধা হয়। চারা লাগানোর থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত দেড় থেকে দুই ইঞ্চি। পানি কম হলে রোপণ ঝুঁকি সামলে উঠতে বেশি সময় লাগে আর বেশি হলে চারা হেলে পড়ে। চারা লাগানোর ১১ দিন পর থেকে থোড় আসা পর্যন্ত এক থেকে দেড় ইঞ্চিপানি থাকতে হবে এর কম বা বেশি হলে কুশি কম হয়। কাইচ থোড় হওয়ার সময় থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত দুই থেকে চার ইঞ্চি পানি থাকা প্রয়োজন। এ সময় রসের ঘাটতি হলে দানা গঠন পুষ্ট হবে না, দানার সংখ্যা কম হবে। আর পানি বেশি হলে গাছ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ধানের দানা শক্ত হলে অর্থাৎ ধান কাটার ১০-১২ দিন আগ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পানি বের করে দিতে হবে।
*** বোরো মৌসুমে ধান আবাদে খরচের অন্যতম প্রধান খাত হলো সেচ। আগামীতে সেচের খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। পানি সাশ্রয়ী একটি কার্যকর পদ্ধতির নাম পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতি বা AWD। জমিতে একটি পর্যবেক্ষণ পাইপ বা চোঙ বসিয়ে সহজেই সেচ দেয়ার সময় নির্ধারণ করা যায়। গভীর নলকূপে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণে করা হলে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ অপচয় রোধ করা যায়, সময় শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে, উঁচু-নিচু জমিতে সহজেই পানি বিতরণ করা সম্ভব। এর ফলে সেচ এলাকা শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
প্রশ্ন ০৫/ ভাইজান বোর ধান চাষে আরো কিকি করনীয় একটু বুঝিয়ে বলেন ?
উত্তর ঃ- বোরো ধান চাষ নিয়ে এক ধরনের প্রচারণা আছে যে, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে ৩০০০-৫০০০ লিটার পানি লাগে। কিন্তু ব্রি ও অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কর্তৃক এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, সেচের পানির হিসেবে কৃষক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত সেচ ব্যবস্থাপনায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করতে ১২০০-১৫০০ লিটার পানি লাগে। অপচয় বাদ দিয়ে শুধু ধানের উৎপাদনে প্রকৃত পানির খরচ হিসাব করলে প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করতে ৫৫০-৬৫০ লিটার পানিই যথেষ্ট। বোরো আবাদ বাড়ানোর জন্য এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা,বিপরীতে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে এবং পাশাপাশি বোরো চাষে পানির অপচয় রোধে কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
*** ধানের জমিতে সেচের মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে লেদা পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, কাটুই পোকা, উড়চুঙ্গা আর রোগের মধ্যে ব্লাস্ট, বাদামি দাগ এবং অধিকাংশ আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
*** অন্যদিকে নিষ্কাশন বা পানি সরিয়ে দেয়া মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে পাতা মাছি, চুংগি পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সাদাপিঠ গাছফড়িং, রোগের মধ্যে বিভিন্ন ছত্রাক রোগ, পাতা পোড়া রোগ এবং আগাছার মধ্যে শেওলা, পানিকচু, কচুরিপানা বা চেচড়া জাতীয় আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
*** নিশ্চিত বোরো মৌসুমকে ঘিরে সঠিকভাবে আগাছা দমন, সার ও সেচ ব্যবস্থা গ্রহণ করে, উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করে গোলা ভরা ফসল ঘরে তুলা সম্ভব।